Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

বাতায়নের ঘটনা পুঞ্জ

ভাষা ও সংস্কৃতি

 

বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার মত ঠাকুরগাঁও জেলার সদর ঠাকুরগাঁও উপজেলার ১৫নং দেবীপুর ইউনিয়নের আঞ্চলিক ভাষার ঐতিহ্য রয়েছে।এ অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা এলাকার মানুষের ভাব বিনিময়ের অকৃত্রিম মাধ্যম।আঞ্চলিক বাংলা ভাষার পাশাপাশি শিক্ষিত,অর্ধশিক্ষিত,অশিক্ষিত সমাজে শুদ্ধ বাংলা চর্চাও রয়েছে।দেবীপুরের  আঞ্চলিক ভাষায় রয়েছে সাধু ভাষার ক্রিয়াপদের একত্র উচ্চারণ কৌশল,উর্দু,হিন্দি,অসমিয়,উড়িয়া,নেপালী শব্দের সরাসরি বা কিছুটা বিকৃত উচ্চারণ।ফলে দেবীপুরের আঞ্চলিক ভাষা দেশের অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষা থেকে ভিন্নতা পেয়েছে।এ উপজেলায় রয়েছে বিভিন্ন আদিবাসীর বসবাস।ইউনিয়নের খলিশাকুড়ি ও টেপাগাঁও আদিবাসি সাঁওতালরা বসবাস করে।তারা সাওতালি ভাষায় কথা বলে।

          আবহমানকাল ধরে মুসলিম,হিন্দু,বৌদ্ধ,খৃস্টান,আদিবাসী ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সহাবস্থানে এ অঞ্চলে অর্পূব এক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সংস্কৃতি বিরাজ করছে।তবে অন্যান্য অঞ্চলের মত এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যেও আচার-ব্যবহার,অভ্যাস,রীতিনীতি,চলাফেরা,ধ্যান-ধারনায় ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়।

এইজনপদে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের সামাজিক সম্বোধনের রূপ অন্যান্য এলাকারমতোই স্বতন্ত্র। তবে নিম্ন শ্রেণীর হিন্দুদের সম্বোধনের প্রকৃতি কিছুটাভিন্নধর্মী। যেমন-মুসলমান দাদী, হিন্দু ঠাকুরমা, নিম্নশ্রেণী-বাই। মুসলমানদুলাভাই/ভাই সাহেব, হিন্দু জামাই বাবু, নিম্নশ্রেণী-বহিনা/আনু। মু-ভাবী, হি-বৌদী, নি, শ্রে-ভৌজি। স্বামী, অর্থে ভাতার শব্দটি এ অঞ্চলে বহুলপ্রচলিত। বলাবাহুল্য এটি প্রাচীন বাংলা শব্দ। বিবাহ শব্দটির এই অঞ্চলেরপরিচিত রূপ বিহা। নিম্নশ্রেণীর হিন্দুদের মধ্যে বিবাহের বিকল্প শব্দ ‘বেচেখাওয়া’ এটিও বহু উচ্চারিত। পূর্বে মেয়ে পক্ষ পণ নিতো; শব্দটিতে সেই স্মৃতিবিজড়িত। প্রাচীন বাংলা রূপের ন্যায় বিধবা শব্দের প্রচলিত রূপ এখানে ‘রাঢ়ি’ বা ‘আড়ি’।

 নিম্নশ্রেণীর হিন্দুদের মধ্যে তালব্য-শ’ ধ্বনির ব্যাপক ব্যবহার লক্ষনীয়। যেমন : কহিশিত, গেইশিত্, খাইশিত।

 সীমান্তবর্তী অঞ্চলে (পশ্চিমাঞ্চল) ক্রিয়াপদের অমেত্ম ল ধ্বনির দ্বিত্ব ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত। যেমন : কোহিল্ল, খাইল্ল, মারিল্ল।

ধ্বনিতত্ত্ব

স্বরধ্বনি: স্বরধ্বনির উচ্চারণ চলিত ভাষার অনুরূপ। আ’ এবং ‘ই’ পরিবেশগত কারণে অনেকসময় অর্ধ স্বরধ্বনির ন্যায় উচ্চারিত হয়। যেমনঃ রাত> আইত এবং জাইত> (জাত)।

আ’ এবং এ-র পর ব্যাঞ্জনধ্বনি হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘ই’ স্বরধ্বনির আগমনঘটেছে। যেমনঃ গেছে থেকে গেইছে, বাদ্য থেকে বাইদ্য, আনছি (আনিতেছি) থেকেআইনছি।

চলিতবাংলায় মূল স্বরধ্বনির সবকটিই আনুনাসিক হতে পারে। আনুনাসিকার ফলে সৃষ্টিহয় স্বতন্ত্র অর্থবোধক শব্দ। ঠাকুরগাঁও অঞ্চলেও এই বৈশিষ্ট্য রক্ষিত।এছাড়া, কণ্ঠনালীয় উষ্ম ব্যঞ্জনধ্বনি হ অনেক সময় আনুনাসিক হয়। যেমন: তাহ, যাহে এঁহে, অঞে, তঁহ। মূল শব্দের নাসিক্য ধ্বনি তদ্ভবে আনুনাসিক হতে পারে(চন্দ্র থেকে চাঁদ) এই নিয়ম কথ্য বাংলায় সুপ্রচলিত। কিন্তু আলোচ্য অঞ্চলেকোন কোন শব্দে আনুনাসিক ধ্বনি নাসিক্য ধ্বনিতে পরিবর্তিত হয়। যেমন-আখি থেকেআঁকি, কাদা থেকে কাঁন্দিয়া, চাঁদ থেকে চান। কোথাও কোথাও আনুনাসিকতাবিলুপ্ত হয়েছে। যেমনঃ বাঁশ থেকে বাশ, খোঁজ থেকে খোজ, ঝাঁকে থেকে ঝাকে।

ব্যঞ্জন ধ্বনি:চলিতভাষার তুলনায় ঠাকুরগাঁও দেবীপুর অঞ্চলের উপভাষায় ব্যঞ্জন ধ্বনিরউচ্চারণ-বৈশিষ্ট্য উল্লেখযোগ্য। এই অঞ্চলে মহাপ্রাণ ঘোষস্পৃষ্ট ঘ, ঝ. গ. জ.ধ. ভ, স্বল্পপ্রাণ ও অঘোষরূপে উচ্চারিত হয়। যেমনঃ বাঘ, ঘুরিয়াল, গাস, গিয়ান, ঝুরে, ঝানায়, জুরিণূ, জামুরি, ধাপ, ভার, ভমরা। তবে ওকার এর পরিবেশেমহাপ্রাণ ঘোষস্পৃষ্টতা বজায় থাকে। যেমন-ঘোড়া, গোরে, ধোয়া, জোওয়াব। এমনকি‘ওকার’ হইলে অঘোষ ধ্বনিও ঘোষবৎ উচ্চারিত হয়। যেমন-কোল্লো, চৌকা, খোন্ডিয়া।

প্রশস্তদন্তমূলীয় অঘোষ-ঘৃষ্ট-‘চ’, দন্তমূলীয় অঘোষ মহাপ্রাণ ঘৃষ্ট-‘ছ’ এবং অঘোষমহাপ্রাণ ওষ্ঠ্য স্পৃষ্ট-‘ফ’ কথিত অঞ্চলে ঘৃষ্ট স্পৃষ্ট ও মহাপ্রাণ হিসেবেউচ্চারিত হয় না। ‘চ’ ও ‘ছ’ উচ্চারণকালে জিভ ঘর্ষিত হয় না। কেবল দন্তমূলকেস্পর্শ করে। যেমনঃ চাম, চেকর, চিতুল চৈত/ছাম, ছিটিয়া, দুয়া/ফা, ফেলেয়া, ফুলা, ফুপা। কখনো কখনো ‘চ’ ধ্বনি ‘ছ’-এ রূপান্তরিত হয়েছে। যেমনঃ মরিচ থেকেমইছ।

ঠাকুরগাঁওঅঞ্চলের কথ্যভাষা ও লোকসঙ্গীতে তাড়নজাত-‘ড়’ সর্বত্র দন্ত্য-র উচ্চারিতহয়েছে। যেমন-আড়ত’ এর উচ্চারণ আরত্, দড়ি থেকে দরি, গুড় থেকে গুর, উড়া থেকেউরা। আলোচ্য অঞ্চলে ড়’-ধ্বনিটি অনুচ্চারিত। কোন কোন ক্ষেত্রে ড়-ধ্বনিমহাপ্রাণ তাড়নজাত ঢ়’এ রূপান্তরিত। যেমনঃ বেড়া-র উচ্চারণ বেঢ়া/বুড়া-রউচ্চারণ বুঢ়া/আরো-র উচ্চারণ আঢ়ো।

‘র’ ধ্বনির ‘অ’ ধ্বনিতে পরিণত হওয়ার বিষয়টি রাজবংশী উপভাষার মতো অত্র অঞ্চলেউচ্চারণে বহু পরিচিত। যেমনঃ রাত থেকে আইত, রান্নাঘর থেকে আন্ধাঘর, রান্নাবাড়া থেকে আন্ধনবাড়ন। লক্ষণীয়, এই পরিবর্তন কেবলমাত্র শব্দের শুরুতেইপ্রযোজ্য।

নাসিক্য-ন’ এবং দন্তমূলীয় পাক্ষিক-‘ল’ ধ্বনি পরস্পর স্থান পরিবর্তন করেছে। যেমনঃনে থেকে লে/নেছে থেকে লেছে/নাগাল থেকে লাগাল/লাথ্থে থেকে নাথ্থে/লুকিয়েথেকে নুকিয়া/লাল থেকে নাল/লাঙ্গল থেকে নাঙ্গল।

দুটিস্বরধ্বনির মাঝখানে অথবা শব্দের শেষে ‘ক’ ধ্বনি থাকলে ‘খ’ অথবা গ’-এরূপান্তরিত হয়েছে। যেমনঃ পুকুর থেকে পোখর, একটা থেকে এখেটা, কাঁথা থেকেখেতা, সবাকে থেকে সগাকে, তোকে থেকে তোখো।

‘গ’ ধ্বনি দুই স্বরধ্বনির মধ্যে থাকলে, কখনো কখনো ঘ-এ পরিণত হয়েছে। যেমনঃ আঁঙ্গিনা থেকে এঘনা, ডাংগা থেকে ডাংবা।

তালব্য-স্পর্শজ’ ধ্বনি অধিকাংশ অঞ্চলের মতো ঠাকুরগাঁয়েও ইংরেজী Z (জেড) ধ্বনির মতোউচ্চারিত হয়। প্রকৃত উচ্চারণ কদাচিত শোনা যায়। যেমনঃ জার, জেহেল, জহর, জাইত।

তাড়নজাত-‘র’ এর স্থলে পাশ্বিক-ল’ এর উচ্চারণ কোন কোন ক্ষেত্রে পরিলক্ষি হয়। যেমনঃ শরীর থেকে শরীল।

রূপতত্ত্ব:

প্রফেসরমুনীর চৌধুরীকে অনুসরণ করে ড: রফিকুল ইসলাম দেখিয়েছেন যে, বাংলাদেশেরউপভাষাসমূহে রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য তিনটি ক্ষেত্রে সর্বাধিক: সর্বনাম, কারক, বিভক্তি ও ক্রিয়া-বিভক্তি। যেমনঃ সর্বনাম: ঠাকুরগাঁও মোর, নেয়াখালী-আর। ঠাকুরগাঁয়ে-‘হামার’ ময়মনসিংহে-‘আমরার’, কুমিল্লায় ‘আমাগো’, বরিশালে ‘মোগো’। কারক বিভক্তিঃ ঠাকুরগাঁয়ে চাকরদেক, পূর্ববঙ্গে-ছাঅরগো, দক্ষিণ বঙ্গে ছঅরগুন।

ক্রিয়া-বিভক্তিঃ ঠাকুরগাঁয়ে-‘বলিম’ (বলবো) পূর্ববঙ্গে-‘কমু’, দক্ষিণ বঙ্গে-‘খইয়ুম’।

ঠাকুরগাঁওভাষা অঞ্চলে প্রাণীবাচক সর্বনামের প্রথম পুরুষে, পুরুষ ও স্ত্রীবাচকরূপভেদ পরিলক্ষিত হয় না। অর্থাৎ পৃথক চিহ্ন নেই। এছাড়া, সাঁওতালী ভাষায়যেমন উভয় লিঙ্গ বাচক শব্দের পূর্বে পুরুষ বা স্ত্রীবাচক কোন শব্দ ব্যবহারকরে লিঙ্গ নির্দেশ করা হয়। আলোচ্য অঞ্চলেও অনুরূপ বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত।যেমনঃ বেটা ছুয়া (ছেলে) মেয়েছেলে, বুঢ়া লোক, বুড়ী মানষী।

আরোএকটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য এই যে, তুমি ও আপনি সর্বনামের ব্যবহার এ অঞ্চলেরভাষায় প্রায় দুর্নিরীক্ষ। আপনি-এর পরিবর্তে অমরা’ এবং মাক শব্দ দুটিতে হ-এরব্যঞ্জনা এ অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য উচ্চারণ-বৈচিত্র এবং তুমি-এর পরিবর্তে তুই/তোমরা খাচ্ছি এর পরিবর্তে খাচু/খানু/ শব্দটি সর্বত্র প্রচলিত।